হিন্দু উত্তরাধিকার আইন

দেশ বিভাগের পর ১৯৫০ সালে জমিদারী অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন প্রবর্তনের ফলে এদেশের কৃষকরা পুনরায় জমির মালিকানা ফিরে পায়। ১৭৯৩ সালের পরবর্তী সময়ে দেশে বিভিন্ন স্বদেশী আন্দোলন ও কৃষকদের বিক্ষোভের মুখে বিভিন্ন আইন করা হলেও ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন দ্বারা কৃষকদের ভূমির সীমিত অধিকার প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৫০ সালে জমিদারী অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হওয়ার ফলে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ হয় এবং কৃষকেরা পুনরায় জমির মালিকানা ফিরে পায় ।

উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি অর্জন –

কোন মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির বন্টনযোগ্য অংশ মৃত ব্যক্তির ধর্মীয় ব্যক্তিগত আইন দ্বারা পরিচালিত হবে। আমাদের দেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য “মুসলিম উত্তরাধিকার আইন” হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য “হিন্দু উত্তরাধিকার আইন” খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জন্য “খ্রিস্টান উত্তরাধিকার আইন” দ্বারা উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয়।

হিন্দু উত্তরাধিকার আইন

হিন্দু আইন হিন্দুদের ব্যক্তিগত আইন। আইন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়ও এর প্রয়োগ রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন আমলে ফৌজদারি বিষয়সমূহ প্রচলিত মুসলিম আইনের অনুশাসন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হলেও দেওয়ানী বিষয়াদিতে হিন্দুদের ব্যক্তিগত প্রথা বা আইনকে স্বীকৃতি প্রদান করা হতো।

হিন্দু আইনের মূল উৎস :

হিন্দু আইনের মূল উৎস ৪টি (ক) বেদ বা শ্রুতি, (খ) স্মৃতি, (গ) ব্যাখ্যা বা নিবন্ধ, (ঘ) প্রথা।

(ক) বেদ বা শ্ৰুতিঃ অতি প্রাচীনকালে দেবতাগণ প্রত্যক্ষভাবে যা বলেছিলেন ও তৎকালে মুনিগণ যা শুনেছিলেন এবং পরবর্তীকালে যা মুনিবর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন কর্তৃক সংকলিত হয় তাই বেদ। ঋক বেদ, যজু বেদ, সাম বেদ ও অথর্ব বেদ এই চারটি বেদকে একত্রে শ্রুতিশাস্ত্র বলা হয়। বেদ হচ্ছে হিন্দুধর্মের মূল ভিত্তি।

(খ) স্মৃতিঃ প্রাচীনকালে মানুষের পালনীয় ঐশ্বরিক নির্দেশাবলি যা আর্য ঋষিগণ গুরু শিষ্য পরম্পরায় আবৃত্তি আকারে স্মরণে রেখেছিলেন, যা পরবর্তীকালে মুনিগণ গ্রন্থ আকারে সংকলিত করেন ইহাই স্মৃতি শাস্ত্ৰ বা সংহিতা নামে পরিচিত।

(গ) ব্যাখ্যা বা নিবন্ধঃ ধর্মীয় অনুশাসনে বিভিন্ন স্মৃতির মধ্যে জটিলতা দেখা দিলে ব্যাখ্যার উদ্ভব হয়। আঞ্চলিক রীতিনীতির সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে পণ্ডিতগণ নিজেদের মতামত বা ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে প্রাচীন আইনের সংশোধন করে থাকেন। ব্যাখ্যাসমূহের মধ্যে দুটি মতবাদই অনুসরণ করা হয়ে থাকে। (১) মিতক্ষরা মতবাদ (২) দায়ভাগ মতবাদ ।

(ঘ) প্রথা : ইহা এমন রীতি যা দেশ, অঞ্চল বা মহল্লায় প্রচলিত থাকাকালে আইনের যোগ্যতা অর্জন করেছে। আদালত কর্তৃক হিন্দু প্রথাকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। যথা-(১) স্থানীয় প্রথা (২) শ্রেণী প্রথা (৩) পারিবারিক প্রথা।

হিন্দু আইনের আধুনিক উৎসসমূহ :

(ক) আদালতের সিদ্ধান্ত বা নজির

(খ) বিধিবদ্ধ আইন

(গ) সুবিচার, ন্যায়পরায়ণতা।

হিন্দু আইনে উত্তরাধিকার :

দায়ভাগ মতে তিন শ্রেণীর উত্তরাধিকারী ক্রমান্বয়ে মৃতের উত্তরাধিকারীর উপযুক্ত । যথা -(ক) সপিণ্ড, (খ) সকুল্য (গ) সমানোদক

(ক) সপিণ্ড : পিতৃকুলের উর্ধ্বতন তিন পুরুষ ও মাতৃকুলের ঊর্ধ্বতন তিন পুরুষের মোট ৬ পুরুষসহ পুরুষ সপিণ্ডের সংখ্যা ৪৮ জন। এছাড়াও বিধবা স্ত্রী, কন্যা, মাতা, পিতামহী, প্রপিতামহীসহ ৫ জন নারী সপিণ্ড রয়েছে। সর্বমোট সপিণ্ডের সংখ্যা ৫৩ জন।

(খ) সকুল্যঃ প্রপিতামহের ঊর্ধ্বতন তিন পুরুষ সকুল্য নামে অভিহিত। শ্রাদ্ধের সময় সপিওদের পিণ্ডদানের পর যা অবশিষ্ট থাকে তা সকুল্যদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। সপিণ্ডের অবর্তমানে সকুল্যগণ ক্রমান্বয়ে উত্তরাধিকারী হয়। সকুল্যের মোট সংখ্যা ৩৩ জন।

(গ) সমানোদক : সকুল্যের ঊর্ধ্বতন সাত পুরুষ সমানোদক নামে অভিহিত। মৃতের সপিণ্ড এবং সকুল্য উত্তরাধিকারীর অবর্তমানে সমানোদকগণ উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করে। সমানোদকের অনুপস্থিতিতে মৃতের সম্পত্তিতে ধর্মীয় গুরু বা চেলাগণ উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করে। উল্লিখিত সকল উত্তরাধিকারীর অবর্তমানে মৃতের সম্পত্তির যাবতীয় দায়দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করে। সমানোদকের সংখ্যা মোট ১৪৭ জন ।

বন্টনযোগ্য সম্পত্তি ও বন্টনের নিয়ম :

১) দায়ভাগ মতে কোন হিন্দু ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি, উত্তরাধিকার হিসাবে প্রাপ্ত সম্পদের আয় থেকে অর্জিত সম্পত্তি এবং নিজস্ব প্রায় থেকে উপার্জিত সম্পত্তি, যা তিনি মৃত্যুকালে অবশিষ্ট রেখে গেছেন তা উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টনযোগ্য।

২) দায়ভাগ মতে কোন হিন্দু জীবদ্দশায় স্বোপার্জিত এবং উত্তরাধিকার সূত্রে সমুদয় সম্পত্তি বা অংশবিশেষ হস্তান্তর করতে পারেন। সমুদয় সম্পত্তি, উইল করলেও বিধবা ভরণপোষণ পাওয়ার যোগ্য।

৩) সপিণ্ড, সকুল্য ও সমানোদকগণের মধ্যে ক্রমানুসারে সম্পদ বন্টনযোগ্য। ৪) অপুত্রক সৎ মাতা তার সৎ পুত্রগণের মধ্যে বাটোয়ারা দাবি করতে পারেন না।

৫) পুত্র/পুত্রগণ থাকলে তারাই সমুদয় সম্পত্তি পাবে। হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের বিধান অনুযায়ী নিকটবর্তী পুরুষ ওয়ারিশ থাকলে পরবর্তীরা সম্পত্তি পাবে না ।

৬) কোন নারী উত্তরাধিকারী সম্পত্তি প্রাপ্ত হলে তিনি জীবনস্বত্ব (সীমিত ভোগদখলের অধিকার) হিসেবে সম্পত্তি পাবেন। নারী উত্তরাধিকারী মারা গেলে সমুদয় সম্পত্তি মূল মৃত ব্যক্তির কাছে ফিরে যাবে। মূল মৃত ব্যক্তির পরবর্তী উত্তরাধিকারী সম্পত্তি পাবে। কোন পুরুষ উত্তরাধিকারী সম্পত্তি না পাওয়া পর্যন্ত এভাবে সম্পতি বারবার মূল মৃত ব্যক্তির কাছে ফিরে যাবে।

image

কোন ব্যক্তি মৃত্যুকালে পূর্ববর্ণিত স্ত্রী, ২ জন পুত্র ও ১ কন্যা রেখে মৃত্যুবরণ করলে দায়ভাগ নিয়ম অনুযায়ী পুত্র সন্তান থাকলে কন্যা কোন সম্পত্তি পাবে না। বিধবা স্ত্রী এক পুত্রের সমান জীবনস্বত্ব পাবেন। বিধবা স্ত্রী এক পুত্রের সমান জীবনস্বত পাবে।

  • বিধবা স্ত্রি………..১/৩(জীবনস্বত)
  • পুত্র (প্রতিজন) ) ….১/৩ অংশ হিসেবে ২/৩ অংশ

উল্লেখ্য যে, স্ত্রী মারা গেলে সমুদয় সম্পত্তি মৃত ব্যক্তির কাছে ফিরে যাবে। মৃত ব্যক্তির নিকটবর্তী ওয়ারিশ হিসেবে পুত্ররাই উক্ত সম্পত্তি পাবে। তাই বর্তমানে মাকে বঞ্চিত করে পুত্ররাই সমস্ত সম্পত্তি হারাহারি হিসাবে ভাগ করে নিচ্ছে। এতে করে সমাজের সাধারণ মানুষ মনে করেন যে পুত্র থাকলে কোন মৃত ব্যক্তির সমুদয় সম্পত্তি পুত্ররাই পাবে। কিন্তু এটি সঠিক নয়। মা (মৃতের স্ত্রী) জীবিতকালীন অবস্থায় এক পুত্রের সমান পরিমাণ জীবনস্বত্ব পাবেন।

image

কোন ব্যক্তি মৃত্যুকালে পূর্ববর্ণিত ২ জন পুত্র ও ১ মৃত পুত্রের পুত্র (পৌত্র) রেখে মৃত্যু বরণ করলে দায়ভাগ নিয়ম অনুযায়ী মৃত পুত্রের পুত্র তার পিতার হিসেবে সম্পত্তি পাবেন।

  • পুত্র (প্রতিজন)…………….. ১/৩ অংশ হিসেবে দুই জন ২/৩ অংশ
  • পৌত্র ………………১/৩ অংশ

দায়ভাগ নিয়ম অনুযায়ী কোন পুত্র জন্মমাত্র পিতার সম্পত্তিতে অধিকার অর্জন করে। কোন পুত্র রেখে পিতার মৃত্যুর আগে মৃত্যুবরণ করলে তার পুত্র তার পিতার (মৃত ব্যক্তি) সম্পত্তি তার অংশ হিসেবে পাবে।

image

কোন ব্যক্তি মৃত্যুকালে পূর্ববর্ণিত স্ত্রী, ৩ কন্যা রেখে মৃত্যুবরণ করলে দায়ভাগ নিয়ম অনুযায়ী বিধবা স্ত্রী সমুদয় সম্পত্তি জীবনস্বত্ব পাবেন।

বিধবা স্ত্রী…………..সমুদয় সম্পত্তি (জীবনস্বত্ব)

উল্লেখ্য যে, স্ত্রী মারা গেলে সমুদয় সম্পত্তি মৃত ব্যক্তির কাছে ফিরে যাবে। মৃত ব্যক্তির নিকটবর্তী ওয়ারিশ হিসেবে ৩ কন্যা হারাহারি হিসেবে সমুদয় সম্পত্তি ভাগ করে নেবে। তারাও সম্পত্তি জীবনস্বত্ব হিসেবে পাবে। তাদের মৃত্যুর পর পরবর্তী ওয়ারিশ সম্পত্তি পাবে। কোন পুরুষ সম্পত্তি না পাওয়া পর্যন্ত সম্পত্তি এভাবেই আবর্তিত হবে।

Scroll to Top